Smartness!

 স্মার্টনেসের সংজ্ঞা আমাদের প্রচলিত ব্যাখ্যা

আমি তখন বেশ ছোট ক্লাশ সিক্সে পড়ি কলোনিতে থাকার সুবাদে ঢাকা বড় শহরের ছেলেমেয়েরা যেসব সুবিধা পায়না আমি তার সবটুকুই পেতাম বলতে গেলে অনেক বেশিই পেতাম বিশেষ করে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করা, কিংবা গাছ থেকে ফল চুরি করা টাইপ কাজগুলো করার অপার স্বাধীনতা ছিল সাইকেল চালানো ছিল এগুলোর মধ্যে অন্যতম পছন্দীয় আরেকটা এক কাজতবে আমাদের বাসা পাঁচ তলাতে হওয়ায় সব সময় সেটা নিয়ে নিচে নামা যেত না, আব্বুর কড়া নিষেধাজ্ঞা , ‌'তুমি সাইকেল চালাতে চাচ্ছ তাই কিনে দিচ্ছি তাই বলে তোমার জন্য অন্য কেউ যেন ঝামেলা না পোহায় বুয়া একবার সাইকেল নিয়ে নিচে দিয়ে ওপরে আসবে আবার সেটা আনার জন্য তুমি ডাকবে সেসব হবে নাতুমি যদি্একা এসব করতে পার তাহলে কর না হলে সাইকেল পড়ে থাক, নষ্ট হলে হোক, কিন্তু অন্যকে কষ্ট দিয়ে কিছু করা যাবেনা


আমি প্রথম প্রথম খুব হ্যা-হ্যা করলাম ঠিক আছে, ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না, বুয়া কেন কষ্ট করবে ইত্যাদি ইত্যাদিও খুব বললামআর মনে মনে বুঝতে পারলাম ভালোই যন্ত্রনায় পড়তে যাচ্ছি এত খাটনি যদি নামানো-ওঠানোতেই চলে যায় তবে আর চালাবো কখন? ভারী সাইকেল নিয়ে পাচতলায় ওঠা-নামা করা কি চাট্টিখানি কথা‍ ! তাও আমার মত একজন ছোট মানুষের পক্ষে!

কয়দিন বেশ উৎসাহের সঙ্গে নামানো ওঠানোর পর অবধারিতভাবেই সেখানে ভাটা পড়ে কাহিল হয়ে কে আর অত কষ্ট করবেসুতরাং নতুন বুদ্ধি, কেবলমাত্র ছুটির দিনে সকাল বেলায় নিচে চালাই,বাকী সময় ছাদে কাটাইবলতে গেলে তখন থেকেই মূলত ছাদই আমার কাছে ধ্যান-জ্ঞান হয়ে যায়ছাদে তুলতে হলে মাত্র এক তলা বাইতে হয় আর বেশ বড় হওয়ায় আমিও কোনো উটকো ঝামেলা ছাড়াই চালাই, মানে নো জ্যাম, নো কারও গায়ের ওপর তুলে দেয়াআর একটা সুবিধাও হলো ছাদে বেশ অল্প জায়গায় টার্ন করাতে হতোএতে করে আমি টার্নিংয়ের ক্ষেত্রে খুব পারদর্শী হয়ে উঠলাম

আমার দেখাদেখি কলোনির আরও বেশ কয়েকটা মেয়ে সাইকলে কিনে চালানো আরম্ভ করল সিনথিয়াকে তো আমিই শিখালাম সে আরেক বিশাল অভিজ্ঞতা

তখন ১৯৯৫ সাল বিএনপির প্রথম টার্ম চলছে খালেদা জিয়াদের পদচ্যুত করার জন্য আওয়ামী লিগ লাগাতার ৭২ ঘন্টা, ৯৬ ঘন্টা হরতালের ডাক দেয় আমার স্কুলের ফ্রেন্ডরা যখন হরতালের কারনে বাসায় বোর, আমি তখন দিন-রাত সাইকলে চালানোয় ভীষন ব্যস্ত

যেহেতু কলোনি এরিয়ার বাইরের রাস্তায় কোনো ধরনের যান চলাচল বি:করেনা, একেবারে ফাকা থাকে তাই তখন আর আমাদের আর পায় কেযাকে বলে পোয়া বারো অবস্থা নিচে নেমেই প্রথম সুযোগে রাস্তায়আমরা প্রায় পাচ-সাতজন মেয়ে মহা আনন্দে রাস্তায় গিয়ে সাইকেল চালাই

আসলে আমার সাইকেল চালানোর দিনগুলো নিয়ে বলার জন্য আজকের লেখার আয়োজন নয় সেসময়কার একটা ঘটনা বলে মূল প্রসঙ্গে যাচ্ছি প্রথমবার চাকা পাম্পিং করানোর সময়কার কথা এমনিতেই সাইকেল সংক্রান্ত কোনো কাজই আব্বু-আম্মু অন্যকে দিয়ে করায় না হ্যান্ডেল মুছে রাখা, বৃষ্টি আসলে ঘরে ঢুকিয়ে রাখা, চাকায় মবিল দেয়া--সব আমাকেই করতে হয়

কিন্তু পাম্পিং করতে হলে একটু সামনের দোকানে যাওয়ার দরকার হয় আমি কখনো করিনি দেখে প্রথম দিন আব্বু সঙ্গে গেলোকিন্তু আমার চালানোর জোয়ারে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার চাকার হাওয়া গায়েবআবার পাম্প দিতে হবে আমি আব্বুকে বলতেই বিরাট এক ঝাড়ি খেলাম

‌'কেন তুমি কেন যেতে পারবানা, যাও, রাস্তাটা পার হয়েই তো আনায়াসে যাওয়া যায়, এই ছোট কাজটা না পারলে বাসায় বসে থাক, কিছু করারর দরকার নাই, ইত্যাদি নানান রকম ভাষ্য

যদিও শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই সেদিন যেতে পেরেছিলাম সেদিন তো অবশ্যই, পরে একাই পাম্পিং করাতে যেতাম দোকানদাররা প্রথমে খুব অবাক হতো কয়দিন পর ঘনঘন যাওয়া দেখে তারাও বুঝে ফেললো যে আমি মোটামুটি নিয়মিত এক ক্ষুদে এবং ব্যতিক্রমী কাস্টমাররাস্তা পার হতে আমার যেনো কোনো বিপদ না হয় সেজন্য কয়েকবার নিজেই পার করে দিয়েছে তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো মেয়ের সাইকেল পাম্পের দোকানে গিয়ে চাকায় হাওয়া দেয়াটা এখনও খুব বেশি পরিচিত দৃশ্য নয় আজও যেমন নয়, আজ থেকে তের-চৌদ্দ বছর আগে তো নয়ই


শুধু যে সাইকেল চালানো নিয়ে আমার বাবা-মা' মনোভাব এমন ছিল সেটা নয়ব্যাডমিন্টন খেলার কর্ক কিনে আনা, ক্লাশ এইটে পড়াকালীন সময় থেকে টেলিফোন বিল দেয়া, দোকান থেকে শুকনা-কাচা বাজার করে আনা, রান্না-বান্না,কাপড় কাচা অর্থ্যাৎ এমন কোনো কাজ নাই যে আমাকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করা হয়নি আব্বু বলত দেখো, তোমার কাজ তোমাকেই করতে হবে, সেটা যত কঠিনই হোক না কেনঅন্য কেউ তোমার কোনো কাজে সাহায্য করবেনা

পারলে কর, না পারলে নাই, তবে এর জন্য কাউকে অভিযোগ করো নামেয়ে বলে শুরুতেই আলাদা সুবিধা চেয়ে বসো নাসাহায্য চাওয়া কোনো সময় সম্মানের নয় সব কিছু নিজে করে ফেলাতেই সভ্যতার বিকাশ হয় হয় আধুনিকতার প্রারম্ভআর সেটাই স্মার্টনেস


কি ভেবে তিনি তার টিন এজার মেয়েকে এমন বলতেন আমি জানিনা তবে তখন তার ওই কথায় আমি খুব রাগ করতাম আমার ছোট পৃথিবীর জন্য বড় বেশি কঠিন মনে হতো ভাবতাম অন্যদের বাবারা-ভাইয়েরা যদি সব কিছু করে দিতে পারে তাহলে কেন আমার বাবা-মা পারবেনা কেন তারা আমাকে দিয়ে সব করাতে চাচ্ছে? তারা কি আমাকে একটুকুও আদর করেনা?

আমি এখন বুঝি তারা অবশ্যই আমাকে অসম্ভব আদর করতেন সেজন্যই এমন করে সব কিছু বলতেন চাইতেন সবদিকেই যেমন তাদের মেয়ে স্বাবলম্বী হতে পারেসেটা অর্থনৈতিকভাবে যেমন তেমন সব কিছুর আনুসাঙ্গিক কর্মকান্ডে

আর আদর মানে মুখ তুলে খাওয়ানো নয় কোনোভাবেই নয়নয় তাকে গোটা পৃথিবীর কাছে একজন অকর্মণ্য মানুষ হিসাবে প্রতিপন্ন করাযখন দায়িত্ব আসবে তখন সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেও কোনো কৃতিত্ব নেই

যদি আমরা প্রত্যেকে নিজেদেরকে একবিংশ শতাব্দীর মেয়ে হিসাবে নিজেকে পুরুষের সমান দাবী করি তাহলে তথাকথিত তাদের সবকাজেও অংশ নিতে হবে সমানভাবেকাজ না করার মধ্যে বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সার্থকতা লুকিয়ে নেই

সেটা আর যাই হোক স্মার্টনেস হতে পারেনাহওয়ার নয়মেয়েদের স্মার্টনেস আর 'সো কলড স্মার্টনেসে' সঙ্গে যেটা আমরা সবাই প্রায়ই গুলিয়ে ফেলিভুলভাবে ব্যাখ্যায় যেখানে স্মার্টনেস নিজেও মনে হয় বেশ বিভ্রান্ত

আসলে যদি মেয়েটিই আশা করে তার বাসের টিকিট অন্য কেউ কেটে দিবে কিংবা ইউনিভার্সিটির ফর্ম তার বড় ভাই তুলে এনে দিলে সে পরীক্ষা দিবে, প্রিন্ট আউট নেয়ার জন্য কার্টিজ বাবা দোকান থেকে এনে দিবে কিংবা পিসি নষ্ট হয়ে গেলে দোকানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছোট ভাইয়ের অথবা যে ছেলে বন্ধু তার প্রতি একটু দূর্বল, তার সেই দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে নোট বাগিয়ে নিবে, সে ফেল করলে করুক তাতে কি যায় আসে তাহলে শুধু শুধূ মেয়েদের সমান অধিকারের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই

লাভ তো দূরে থাক তখন ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি এতদিনের চারপাশের জগত দেখে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়

কেউ কেউ পাশ্চাত্য-পূর্বের সংস্কৃতির অহেতুক মিশ্রনে নিজেদের ভাসিয়ে রেখে আরও পিছনের দিকে চলে যাওয়ার চিন্তায় মত্ত থাকতে বেশি পছন্দ করেযার আরেক নাম হঠকারিতা সুন্দর করে বললে অনগ্রসর বা কূপমন্ডকতায় পরিপূর্ণ মানসিকতা

প্রচলিত কৃষ্টি-কালচারের দোহাই দিয়েও কেন জানি কেবলমাত্র পোষাক-আশাকের মধ্যেই নিজের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রাখায় অদ্ভুত চিন্তা ব্যক্ত করা হয়

কারন এখনতো মাল্টি ন্যশনাল কোম্পানির যুগ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড, হাই-ফাই এনভারনমেন্টর চাকচ্যিময় অফিস যতোই বাইরের উজ্জ্বলতার তুলনায় ভেতরের অবস্থা নেহায়েত কঙ্কালসারশূণ্য থাকুক, তারপরও তারা জব মার্কেটে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানেকর্পোরেট হাউসে কোনো মেয়ের এক্সপ্লয়েট হতে পারটাই তাদের বিবেচনায় সবচেয়ে বড় সফলতা বলে গন্য এতেই নাকি বোঝা যায় তার ডিমান্ড মার্কেটে কত! কি ভয়াবহ অবস্থামেয়েটাও অনেক সময় বুঝে কখনো বা নিজের অসহায়ত্বের কারনে পরিস্থিতির শিকার

তবে এর নাম যদি আধুনিকতা হয় তাহলে অন্তত এই নতুন বেড়াজালের দরকার নেইকোনো দরকার নেই

দরকার নেই শিক্ষিত হয়ে নতুন করে পুরোনো বেড়াজালে বন্দী হয়ে আগের বন্দীত্বে কারাবরন করার

যেন আজকালকার অতি আধুনিক মেয়ে মানে শুধু জিনস আর ফতুয়া পরা কেউজিনস ফতুয়া খারাপ সেটা বলছিনা, তবে শুধু সেটা পরলেই আধুনিক হওয়া যাবে সেটাই বা কেমন নিয়ম?

নিয়মই তবে অলিখিত

তাকে সিগারেট-ফেনসিডিল-গাজা খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রাত দশটায় বাসায় আসতে হবে কিংবা নিদেন পক্ষে চার-পাচটা বয়ফ্রেন্ড থাকল্ই কেবল ফ্রেন্ড সার্কেলে স্ট্যাটাস বাড়বে সেটাও বা কোথাকার আইন?যখন তখন এর-ওর সঙ্গে শুয়ে পড়তে পারলেই মনে হয় যেন হাই সোসাইটির বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ মিলে,উদারতার পরিচয় পাওয়া যায় মেয়েটিও তখন ছেলেদের কাছে তথা কথিত নারী স্বাধীনতার ধারক বাহক বলে প্রমানিত হয় কারন ওটাই নাকি আধুনিকতার সবচেয়ে বড় সংজ্ঞা অগ্রসরতা সবচেয়ে বড় উদাহরন

আমি অবশ্যই সব ক্ষেত্রে মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার যুক্তিকে জোরাল সমর্থন জানাইস্বাধীনতা কোনো দাবী নয় সবার সমান অধিকারতবে সেটার জন্য শুরুতে প্রয়োজন কষ্ট সহ্য করাবর মানসিকতা সবকিছু কিন্তু এমনি এমনি আসবেনা কারও জন্যই আসে না সেটা যেমন একজন ছেলেদের জন্য না, মেয়ের জন্যও না

সব জায়গায় সফলতা পাওয়ার আগে এই সত্যটুকু উপলব্ধি করা আমারাদের সকলের বিশেষ করে মেয়েদেরই একান্ত প্রয়োজন

বিঃ দ্রঃ: জানি আজকের এই পোস্ট মেয়েদেরই ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে তবে সবটুকুই বাস্তব নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখলাম যা অনুভব করি সেটাই প্রকাশ করলাম


Comments

Popular posts from this blog

For my blog readers

Speed up Firefox

How to turn on wireless zero configuration in XP